ঢাকা , রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হিংসা-বিভেদ নয়, সামনে দেশ গড়ার কাজ: রাষ্ট্রপতি

জাতীয় সংসদে শেষ ভাষণে আবদুল হামিদ বলেছেন, ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পন্থা নির্বাচন, সেখানে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কখনোই কল্যাণকর নয়।
রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শেষবার জাতীয় সংসদে বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে ‘ঐকমত্যের’ মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ‘বিকশিত’ হওয়ার সুযোগ দিতে সকল দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।

তিনি বলেছেন, ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পন্থা নির্বাচন, সেখানে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কখনোই কল্যাণকর নয়।

জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ অধিবেশনে শুক্রবার বিকালে স্মারক বক্তৃতা দিচ্ছিলেন আবদুল হামিদ, যাকে পাঁচ দশকের বেশি সময় আইনপ্রেণেতা, স্পিকার এবং রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকায় দেখেছে দেশের আইনসভা।

টানা দুই মেয়াদে দায়িত্বপালন শেষে আগামী ২৩ এপ্রিল বিদায় নিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তাই রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংসদে এটাই ছিল আবদুল হামিদের শেষ ভাষণ।

তিনি বলেন, “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। ক্ষমতায় যাওয়া বা পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় নির্বাচন। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি কখনও দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না, বরং তা রাজনৈতিক পরিবেশকে তমসাচ্ছন্ন করে তোলে।

“সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে আমাদের সকলের সহায়তা করা উচিত। রাজনীতি থেকে হিংসা-হানাহানি অবসানের মাধ্যমে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে হবে।”

সব কিছুর চেয়ে দেশ যে বড়, সেই সত্যটি তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, “দেশের উন্নয়নে আমাদের চিন্তা, কর্মপদ্ধতি ও কৌশল ভিন্ন হতে পারে কিন্তু আমাদের মধ্যে সুগভীর ঐক্য থাকবে জাতীয় স্বার্থ ও দেশপ্রেমের প্রশ্নে। হিংসা-বিভেদ নয়, স্বার্থের সংঘাত নয় – আমাদের সামনে রয়েছে আজ দেশ গড়ার কাজ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা গড়ে দিয়ে যাব একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ – এই হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।”

আবদুল হামিদের স্মারক বক্তৃতায় বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলার কথা।

বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদে নানা ঘটনার স্মৃতি তিনি স্মরণ করেছেন; তার বক্তৃতায় বার বার এসেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। আবদুল হামিদের ভাষায়, “বঙ্গবন্ধুর অপার স্নেহ আর তার দূরদর্শিতার কারণেই আমি আজকের এই অবস্থানে পৌঁছেছি।”

গণতন্ত্রের জন্য বাঙালির সংগ্রামের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, “আজ মহান জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। গণতন্ত্রের পথে আমাদের অগ্রযাত্রা যখনই বাধাগ্রস্ত হয়েছে তখনই এর একটি প্রভাব পড়েছে জাতীয় সংসদের উপর। বিগত দেড় দশকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে।”

প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশের জনগণ নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ ও বেগবান করবে- এই প্রত্যাশার কথাও তিনি বলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে আবদুল হামিদ বলেন, গত ১৪ বছরে প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ ও সুদৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল হওয়ার সব যোগ্যতা অর্জন করেছে।

“তারই নেতৃত্বে দেশের গণতন্ত্র আজ নিরাপদ ও সুরক্ষিত। বর্তমানে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি ব্যতীত অন্য কোনো গোষ্ঠী বা অসাংবিধানিক শক্তির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ নেই।”

১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আবদুল হামিদ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল ঢাকার তেজগাঁওয়ের সংসদ ভবনে শুরু হয়। গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর আমাদের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে তা কার্যকর হয়।

“স্বাধীনতার এত অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রকামী যেকোনো দেশের জন্য গর্বের। এই সংবিধানে প্রথম স্বাক্ষরকারী আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি স্বাক্ষর করি ৭১ নম্বরে।”

ওই সংবিধানের আওতায় পরের বছরের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। এক মাস পর ৭ এপ্রিল বসে সংসদের প্রথম অধিবেশন।
শুক্রবার বিকালে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বর্তমান সংসদের এই ২২তম অধিবেশন শুরু হয়। সুবর্ণজয়ন্তী বিশেষ অধিবেশন বৃহস্পতিবার শুরু হয়েছিল।

বিকাল ৩টার পরে সংসদে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন রাষ্ট্রপতি। এসময় স্পিকার তাকে স্বাগত জানান।

স্মারক বক্তৃতায় রাষ্ট্রপতি দেশের আইনসভার সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, জাতীয় সংসদ গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সর্বোচ্চ এ প্রতিষ্ঠান জনগণের আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে জনমত ও প্রত্যাশাকে ধারণ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীলতা এবং দৈনন্দিন নাগরিক জীবনের জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এটাই জনগণ আশা করে।

“রাজনৈতিক মতপার্থক্য এবং নীতি-আদর্শের ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু সংসদকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে কোনো ভিন্নতা থাকতে পারে না। তাই আপনাদের প্রতি আমার আকুল আহ্বান সংসদকে কার্যকর করতে ঐক্যবদ্ধ হোন।”

জাতীয় সংসদে সকল স্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ‘অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে বর্ণনা করেন রাষ্ট্রপতি। তারপরও সেটা অর্জনে সবসময় সচেষ্ট থাকার তাগিদ দেন।

তিনি বলেন, “জাতীয় সংসদের কার্যক্রমকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করতে হলে সংসদ সদস্যদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। যুক্তিতর্কের সঙ্গে বিতর্কে অংশ নিতে হবে। সংসদ সদস্য হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হলে সংবিধান, কার্যপ্রণালী বিধি, সংসদীয় রীতিনীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হবে।”

প্রায় আধ ঘণ্টার এ ভাষণের শুরুতে আবদুল হামিদ বলেন, “জাতীয় সংসদের গৌরবোজ্জ্বল পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এ বিশেষ অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে পারা আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গৌরবের। এ জন্য আমি পরম করুণাময় আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি আনন্দঘন ও অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।

“আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল সময় কেটেছে শেরেবাংলা নগরের উন্মুক্ত সবুজ পরিসর ও মনোরম জলাধারে ঘেরা মার্কিন স্থপতি লুই আই কানের অনন্যসাধারণ সৃষ্টি, পৃথিবীর অন্যতম দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা এই জাতীয় সংসদ ভবনে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে আজকের এই ভাষণটি মহান জাতীয় সংসদে আমার শেষ ভাষণ।”

দেশের অগ্রযাত্রার ইতিহাসের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, “জাতীয় সংসদের ইতিহাস নতুন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য এই বিশেষ অধিবেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি। আমি আশা করি, সংসদ সদস্যরা তাদের বক্তব্যে সংসদের ইতিহাসের পাশাপাশি সংসদ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর রীতিনীতি, কর্মকৌশল এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেও দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরবেন।”
দেশের গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানিযোগ্য কোনো পণ্য বা সেবা নয়। মনে চাইল কোনো দেশ থেকে পরিমাণমত গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানি করলাম, বিষয়টি এমন নয়।

“চর্চার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র বিকশিত ও শক্তিশালী হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সংসদের কার্যবাহে সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যগুলো পড়লে বোঝা যায় সংসদকে কিভাবে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করতে হয়।”

রাষ্ট্রপতি বলেন, “পরমতসহিষ্ণুতা, বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়া এবং অন্যকে কীভাবে সম্মান দেওয়া যায় এসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় নজির রেখে গেছেন। আমাদের সৌভাগ্য আমরা বঙ্গবন্ধুর মত একজন বিশ্বমানের কিংবদন্তি নেতা পেয়েছিলাম।

“দুর্ভাগ্য আমরা তাকে ধরে রাখতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু তার নীতি-আদর্শ আমাদের চিরন্তন প্রেরণার উৎস। তার দেখানো পথেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায়।”

ট্যাগস

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপলোডকারীর তথ্য

গ্রিন টিভি বাংলা

গ্রিন টিভি বাংলার একটি সম্পূর্ন অনলাইন ফেজবুক,ইউটিউব, নিউজপোর্টাল ভিক্তিক টিভি চ্যানেল । যে কোন বিষয় মতামত দিয়ে আমাদেকে সহযোগিতা করুন এবং নিউজ পড়ুন বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের সাথে থাকুন

হিংসা-বিভেদ নয়, সামনে দেশ গড়ার কাজ: রাষ্ট্রপতি

আপডেট সময় ০৭:০৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ এপ্রিল ২০২৩

জাতীয় সংসদে শেষ ভাষণে আবদুল হামিদ বলেছেন, ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পন্থা নির্বাচন, সেখানে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কখনোই কল্যাণকর নয়।
রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শেষবার জাতীয় সংসদে বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে ‘ঐকমত্যের’ মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ‘বিকশিত’ হওয়ার সুযোগ দিতে সকল দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।

তিনি বলেছেন, ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পন্থা নির্বাচন, সেখানে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কখনোই কল্যাণকর নয়।

জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ অধিবেশনে শুক্রবার বিকালে স্মারক বক্তৃতা দিচ্ছিলেন আবদুল হামিদ, যাকে পাঁচ দশকের বেশি সময় আইনপ্রেণেতা, স্পিকার এবং রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকায় দেখেছে দেশের আইনসভা।

টানা দুই মেয়াদে দায়িত্বপালন শেষে আগামী ২৩ এপ্রিল বিদায় নিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তাই রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংসদে এটাই ছিল আবদুল হামিদের শেষ ভাষণ।

তিনি বলেন, “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। ক্ষমতায় যাওয়া বা পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় নির্বাচন। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি কখনও দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না, বরং তা রাজনৈতিক পরিবেশকে তমসাচ্ছন্ন করে তোলে।

“সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে আমাদের সকলের সহায়তা করা উচিত। রাজনীতি থেকে হিংসা-হানাহানি অবসানের মাধ্যমে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে হবে।”

সব কিছুর চেয়ে দেশ যে বড়, সেই সত্যটি তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, “দেশের উন্নয়নে আমাদের চিন্তা, কর্মপদ্ধতি ও কৌশল ভিন্ন হতে পারে কিন্তু আমাদের মধ্যে সুগভীর ঐক্য থাকবে জাতীয় স্বার্থ ও দেশপ্রেমের প্রশ্নে। হিংসা-বিভেদ নয়, স্বার্থের সংঘাত নয় – আমাদের সামনে রয়েছে আজ দেশ গড়ার কাজ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা গড়ে দিয়ে যাব একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ – এই হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।”

আবদুল হামিদের স্মারক বক্তৃতায় বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলার কথা।

বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদে নানা ঘটনার স্মৃতি তিনি স্মরণ করেছেন; তার বক্তৃতায় বার বার এসেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। আবদুল হামিদের ভাষায়, “বঙ্গবন্ধুর অপার স্নেহ আর তার দূরদর্শিতার কারণেই আমি আজকের এই অবস্থানে পৌঁছেছি।”

গণতন্ত্রের জন্য বাঙালির সংগ্রামের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, “আজ মহান জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। গণতন্ত্রের পথে আমাদের অগ্রযাত্রা যখনই বাধাগ্রস্ত হয়েছে তখনই এর একটি প্রভাব পড়েছে জাতীয় সংসদের উপর। বিগত দেড় দশকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে।”

প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশের জনগণ নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ ও বেগবান করবে- এই প্রত্যাশার কথাও তিনি বলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে আবদুল হামিদ বলেন, গত ১৪ বছরে প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ ও সুদৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল হওয়ার সব যোগ্যতা অর্জন করেছে।

“তারই নেতৃত্বে দেশের গণতন্ত্র আজ নিরাপদ ও সুরক্ষিত। বর্তমানে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি ব্যতীত অন্য কোনো গোষ্ঠী বা অসাংবিধানিক শক্তির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ নেই।”

১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আবদুল হামিদ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল ঢাকার তেজগাঁওয়ের সংসদ ভবনে শুরু হয়। গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর আমাদের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে তা কার্যকর হয়।

“স্বাধীনতার এত অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রকামী যেকোনো দেশের জন্য গর্বের। এই সংবিধানে প্রথম স্বাক্ষরকারী আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি স্বাক্ষর করি ৭১ নম্বরে।”

ওই সংবিধানের আওতায় পরের বছরের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। এক মাস পর ৭ এপ্রিল বসে সংসদের প্রথম অধিবেশন।
শুক্রবার বিকালে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বর্তমান সংসদের এই ২২তম অধিবেশন শুরু হয়। সুবর্ণজয়ন্তী বিশেষ অধিবেশন বৃহস্পতিবার শুরু হয়েছিল।

বিকাল ৩টার পরে সংসদে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন রাষ্ট্রপতি। এসময় স্পিকার তাকে স্বাগত জানান।

স্মারক বক্তৃতায় রাষ্ট্রপতি দেশের আইনসভার সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, জাতীয় সংসদ গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সর্বোচ্চ এ প্রতিষ্ঠান জনগণের আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে জনমত ও প্রত্যাশাকে ধারণ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীলতা এবং দৈনন্দিন নাগরিক জীবনের জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এটাই জনগণ আশা করে।

“রাজনৈতিক মতপার্থক্য এবং নীতি-আদর্শের ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু সংসদকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে কোনো ভিন্নতা থাকতে পারে না। তাই আপনাদের প্রতি আমার আকুল আহ্বান সংসদকে কার্যকর করতে ঐক্যবদ্ধ হোন।”

জাতীয় সংসদে সকল স্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ‘অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে বর্ণনা করেন রাষ্ট্রপতি। তারপরও সেটা অর্জনে সবসময় সচেষ্ট থাকার তাগিদ দেন।

তিনি বলেন, “জাতীয় সংসদের কার্যক্রমকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করতে হলে সংসদ সদস্যদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। যুক্তিতর্কের সঙ্গে বিতর্কে অংশ নিতে হবে। সংসদ সদস্য হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হলে সংবিধান, কার্যপ্রণালী বিধি, সংসদীয় রীতিনীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হবে।”

প্রায় আধ ঘণ্টার এ ভাষণের শুরুতে আবদুল হামিদ বলেন, “জাতীয় সংসদের গৌরবোজ্জ্বল পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এ বিশেষ অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে পারা আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গৌরবের। এ জন্য আমি পরম করুণাময় আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি আনন্দঘন ও অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।

“আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল সময় কেটেছে শেরেবাংলা নগরের উন্মুক্ত সবুজ পরিসর ও মনোরম জলাধারে ঘেরা মার্কিন স্থপতি লুই আই কানের অনন্যসাধারণ সৃষ্টি, পৃথিবীর অন্যতম দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা এই জাতীয় সংসদ ভবনে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে আজকের এই ভাষণটি মহান জাতীয় সংসদে আমার শেষ ভাষণ।”

দেশের অগ্রযাত্রার ইতিহাসের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, “জাতীয় সংসদের ইতিহাস নতুন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য এই বিশেষ অধিবেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি। আমি আশা করি, সংসদ সদস্যরা তাদের বক্তব্যে সংসদের ইতিহাসের পাশাপাশি সংসদ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর রীতিনীতি, কর্মকৌশল এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেও দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরবেন।”
দেশের গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানিযোগ্য কোনো পণ্য বা সেবা নয়। মনে চাইল কোনো দেশ থেকে পরিমাণমত গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানি করলাম, বিষয়টি এমন নয়।

“চর্চার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র বিকশিত ও শক্তিশালী হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সংসদের কার্যবাহে সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যগুলো পড়লে বোঝা যায় সংসদকে কিভাবে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করতে হয়।”

রাষ্ট্রপতি বলেন, “পরমতসহিষ্ণুতা, বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়া এবং অন্যকে কীভাবে সম্মান দেওয়া যায় এসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় নজির রেখে গেছেন। আমাদের সৌভাগ্য আমরা বঙ্গবন্ধুর মত একজন বিশ্বমানের কিংবদন্তি নেতা পেয়েছিলাম।

“দুর্ভাগ্য আমরা তাকে ধরে রাখতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু তার নীতি-আদর্শ আমাদের চিরন্তন প্রেরণার উৎস। তার দেখানো পথেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায়।”