জাপান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন টোকিও সফরের জন্য আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছে এবং বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করবে বলে আশা করছে।
ঢাকায় জাপানের রাষ্ট্রদূত বাসসকে বলেছেন, “এ সফর জাপান সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত প্রত্যাশিত এবং প্রত্যাশা অনেক বেশি।” জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি ৪ মাস আগে ঢাকায় তার নতুন দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশী মিডিয়ায় এটি তার প্রথম বিশেষ সাক্ষাৎকার।
বাসসের কূটনৈতিক প্রতিবেদক তানজিম আনোয়ারের সাথে আলাপকালে রাষ্ট্রদূত বলেন, বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ঢাকা ও টোকিও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করার পথে রয়েছে।
তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ক্রমবিকাশ ঘটছে। বাংলাদেশের অবস্থান মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পথে রয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ঢাকার সঙ্গে আমাদের (জাপানের) সম্পর্ক অনিবার্যভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে।”
কিমিনোরি বলেন, শেখ হাসিনার এ সফরের মাধ্যমে টোকিও ঢাকার সাথে সম্পর্ক গভীর করবে বলে আশা করছে। তার দেশ বাংলাদেশের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে “দাতা-গ্রহীতা” সম্পর্কের পরিবর্তে “সমান অংশীদারিত্বের” ভিত্তিতে সম্পর্ক জোরদারের কথা ভাবছে।
তিনি আরো বলেন, “সমান অংশীদার মানে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ আমাদের সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু হবে।”
শেখ হাসিনা তার জাপানি সমকক্ষ কিশিদা ফুমিওর আমন্ত্রণে ২৫-২৮ এপ্রিল জাপানে সরকারী সফরে যাবেন। দুই নেতা শীর্ষ বৈঠক করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা এছাড়াও কিমিনোরি আয়োজিত একটি ওয়ার্কিং ডিনারে যোগ দিবেন।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সফরকালে দুই দেশ বেশ কয়েকটি সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেন, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে অগ্রগতি, নতুন উন্নয়ন উদ্যোগ, নিরাপত্তা সহযোগিতা, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ, রোহিঙ্গা সংকট এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত বিষয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং চুক্তি
রাষ্ট্রদূত বলেন, ফুমিও এবং শেখ হাসিনা দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করবেন।
কিমিনোরি বলেন, অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির লক্ষ্যে আমাদের আলোচনা সঠিক পথে রয়েছে বলে আশা করা হচ্ছে যে, বিষয়টিকে দুই নেতা স্বাগত জানাবেন। এটি হচ্ছে একটি প্রতীকী কাঠামো যা আমরা আরো জোরদার অর্থনৈতিক সম্পর্কের জন্য সম্পাদন করতে চাইছি।
বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে সম্ভাব্য দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার জন্য জাপান গত বছরের ডিসেম্বরে একটি যৌথ গবেষণা গ্রুপ গঠন করেছে।
রাষ্ট্রদূত জানান, যৌথ গ্রুপ চলতি মাসের শুরুর দিকে টোকিওতে তাদের প্রথম বৈঠক করেছে। জাপান সরকার দুই দেশের মধ্যে অধিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য সর্বোত্তম পদক্ষেপগুলি অন্বেষণ করতে এই ধরণের কয়েকটি বৈঠক করার পরিকল্পনা করছে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে চাই।
কিমিনোরি বলেন, জাপান বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের বিষয়টিকে অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঢাকার সঙ্গে ‘সুষম সম্পর্ক’ রাখার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ জোরদার করতে টোকিও আড়াইহাজারে জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চলে যত বেশি সম্ভব জাপানি কোম্পানিকে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করতে চায়, যেটি গত বছরের ডিসেম্বরে চালু করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, “শিল্প খাতে বৈচিত্র্য আনতে বাংলাদেশ সরকারের ধারণা বাস্তবায়নে আমরা সাহায্য করতে পারি কারণ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। টোকিও বাংলাদেশের আইসিটি খাতকে জাপানি বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে পেয়েছে।
নিরাপত্তা সহযোগিতা
রাষ্ট্রদূত বলেন, টোকিও জাপান-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে “কৌশলগত অংশীদারিত্ব” হিসাবে উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করতে চায় এবং এটি অর্জনের জন্য নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানো একটি “গুরুত্বপূর্ণ উপাদান”।
রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার জন্য নিরাপত্তা সহযোগিতা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাপানিজ অফিসিয়াল সিকিউরিটি অ্যাসিসটেন্স (ওএসএ) নামে নতুন উদ্যোগের অধীনে টোকিও বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তিনি বলেন, জাপান ওএসএ কর্মসূচির মাধ্যমে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে চাইছে না। বরং টোকিও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশসহ কয়েকটি নির্বাচিত দেশকে সামরিক সহায়তা দিতে চায়।
রাষ্ট্রদূত বলেন, “আমাদের লক্ষ্য অস্ত্র বিক্রি করা নয়, কিছু নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইটেম প্রদান করা যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখবে। আমরা বলেছি যে, বাংলাদেশ সেই দেশগুলির মধ্যে একটি। আমরা এ বিষয়টি দেখব।
তিনি বলেন, বর্তমানে জাপান ও বাংলাদেশ সরকার নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
তিনি বলেন, “অফিসিয়াল সিকিউরিটি অ্যাসিসটেন্স প্রদানের সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ ও জাপান সরকারের আমরা মধ্যে আলোচনা করছি।”
রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ ও জাপানের দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে টোকিওতে তাদের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সময় অফিসিয়াল সিকিউরিটি অ্যাসিসটেন্স সংক্রান্ত বিষয়টি স্থান পেতে পারে। বিষয়টি এখনও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।
কিমিনোরি বলেন, দুই দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে “মানুষে মানুষে” যোগাযোগ বাড়াতে জাপানের নৌবাহিনীর জাহাজ চলতি বছর ও গত বছর বাংলাদেশ সফরে আসার পর নিরাপত্তা সহযোগিতা প্রদানের বিষয়ে জাপানের আগ্রহের প্রতিফলন ঘটে।
তিনি আরো বলেন, “আমি মনে করি নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মধ্যে একটি হল শুধুমাত্র একটি দেশকে কিছু সরঞ্জাম বা কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া নয় বরং মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর যোগাযোগ এবং সংলাপ করার সুযোগ থাকা।
নতুন উদ্যোগ
উন্নয়ন সহায়তা সংক্রান্ত নতুন কোনো উদ্যোগের প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেন, সফরকালে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির সাথে যোগাযোগের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, টোকিও মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু এখনও বন্দর ও অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ নিশ্চিত করার বিষয়ে “সত্যিকারের অর্থে” কিছু “ঘাটতি” রয়েছে। “এটি একটি নতুন উদ্যোগ।”
গত মাসে ভারত সফরকালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও বলেছিলেন যে, টোকিও সমগ্র অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি উৎসাহিত করতে নয়াদিল্লি এবং ঢাকা উভয়ের সহযোগিতায় বঙ্গোপসাগর থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে একটি “শিল্প শৃঙ্খল” গড়তে চায়।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এর সহায়তায় কক্সবাজার জেলায় গভীর সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণের কাজ বর্তমানে চলমান রয়েছে যা জাপানের ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো প্যাসিফিক (এফওআইপি) পরিকল্পনার অংশ।
ফ্রি এবং ওপেন ইন্দো প্যাসিফিক (এফওআইপি)
রাষ্ট্রদূত বলেন, টোকিওতে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক শীর্ষ বৈঠককালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও জাপানের এফওআইপি পরিকল্পনা সম্পর্কে তার অভিমত বিনিময় করবেন।
তিনি বলেন, “জাপানের এফওআইপিতে বাংলাদেশ সরকার যোগ দেবে কি না, সে বিষয়ে আমাদের (জাপানি) প্রধানমন্ত্রী এই ধারণাটি নিয়ে (বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে) আলোচনা করবেন।”
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা তার সাম্প্রতিক ভারত সফরকালে বিস্তারিতভাবে এফওআইপি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন যেখানে তিনি ভারত ছাড়াও বাংলাদেশের জন্য পরিকল্পনা উন্মোচন করে বলেছেন যে, টোকিও সমগ্র অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বঙ্গোপসাগর থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত পর্যন্ত শিল্প শৃঙ্খল গড়ে তোলার ধারণা বাস্তবায়ন করতে চায়।
জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেন, টোকিও দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনতে অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক উদ্যোগের পক্ষে সমর্থন চাইছে। তার দেশ মনে করে যে, ঢাকাও অবাধ, সুষ্ঠু ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল চায়। জাপান এবং বাংলাদেশের মধ্যে কিছু অভিন্ন বোঝাপড়া রয়েছে।
কিমিনোরি বলেন, জাপান যে কোনো আঞ্চলিক অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্মে যোগ দিতে বাংলাদেশকে স্বাগত জানায় সেসব ফোরামে যুক্তরাষ্ট্র বা চীন থাকুক বা না থাকুক।
রোহিঙ্গা সংকট
রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের “মৌলিক ধারণা” অর্থাৎ টেকসই, নিরাপদ, স্বেচ্ছায় এবং মর্যাদাপূর্ণ উপায়ে মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করার বিষয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে আলোচনা করা হবে।
তিনি বলেন, জাপান বাংলাদেশের ভূখ-ে এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য উদারতার প্রশংসা করেছে। টোকিও এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে সমর্থন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা এবং স্বাগতিক সম্প্রদায়ের জন্য মানবিক সহায়তা প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি বলেন, “আমরা (জাপান) বাংলাদেশের বোঝা কমাতে বিভিন্ন পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য নিজেদের অঙ্গীকার অব্যাহত রাখব।”
রাষ্ট্রদূত বলেন, দুই প্রধানমন্ত্রী ইউক্রেন সংঘাতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করতে পারেন। জি৭ সদস্য হিসাবে জাপান চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার মোকাবেলায় উন্নয়নশীল দেশগুলিকে কীভাবে সহায়তা করতে পারে সে বিষয় নিয়েও টোকিও মত বিনিময় করতে পারে।
(বাসস)